ছেলের বাংলা খাতা দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো রীমার। অসংখ্য ভুল বানানে। টিচার তাকে বর্ষাকাল নিয়ে একটা লেখা লিখতে বলেছে। মাঝে মাঝে মায়ের সাহায্য নিয়ে লেখাটা শেষ করলো সে। রীমা বললো,
খাতাটা নিয়ে এসো। একটু পড়ে দেখি।
অভি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। বাংলা ক্লাস যেদিন থাকে সেদিন যেন তাকে ভূতে ধরে। কিন্তু আজ পড়া মুখস্থ করতে দেননি টিচার। নিজে থেকে লিখে নিয়ে আসতে বলায় খুব খুশি।
অভি খাতা নিয়ে আসলো। মুখে তার বিজয়ীর হাসি। রীমা হাসি হাসি মুখ করে রাখলেও ক্লাস নাইনে পড়া ছেলের বানানে এতো ভুল দেখে মনটা খারাপ। অথচ কী সহজে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে সে বের করে ফেলে কতোকিছু।
অভি, তোর শব্দগুলো তো ভূতের মতো ভয় দেখাচ্ছে রে! শাসন করে লাভ নেই। তাকে বুঝাতে হবে। সরাসরি বুঝাতে গেলেও ঝামেলা। তাই রীমা কৌতুক করে বললো।
ভূতের মতো ভয় দেখাচ্ছে! কী বলো মা! অভি অবাক।
শীতে গাছের পাতা ঝড়ে যায়। এসময় ঘরে ঘরে পিটা তৈরি হয়। ঝড়, পিটা এগুলো দেখে তো আমি ভয় পাচ্ছি। রীমা হাসছে।
অভি বুঝতে পারে কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু সে ধরতে পারছেনা দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। বললো, এবার বুঝেছি তুমি মজা করছো আমার লেখা নিয়ে। দাও এটা আমি ছিঁড়ে ফেলে দেবো।
ওমা! এতে রাগের কী হলো? আচ্ছা, আমি কাজ সেরে তোকে নিয়ে বসছি।
দুপদাপ করে অভি চলে গেলো নিজের ঘরে। রীমা কাজ সারছে। ভাবছে, ভুলটা অভির নয়। তার নিজেরও আছে। অফিস, বাসা দুটো সামলাতে গিয়ে সময় হয় না। শুক্রবার শনিবার দুটো দিন ছুটির। বাড়িতে পুরো সপ্তাহের জমানো কাজ। এরমধ্যে পড়ে নানা অনুষ্ঠান। সময় কোথায় ছেলেকে দেখার! বাসায় টিচার আসে। তার কাছে দিয়ে নিশ্চিন্ত ওরা।
বিকেলে নাস্তা নিয়ে বসলো বারান্দায়। অভি গীটারে টুংটাং শব্দ তুলছে। কিন্তু কোনো সুর নেই। মেজাজ খারাপ হলেই সে এটা করে। রীমা ডাক দিলো বারান্দায় আসার জন্যে। চুপচাপ মা'র পাশে এসে বসলো। ছেলের এই স্বভাবটা রীমার অনেক ভালো লাগে। জেদ ধরে থাকে না। কিন্তু অভিমান ঠিকই থাকে।
মা তো এমন কিছু বলিনি। মন খারাপ করেছিস কেন!
তুমি আমার খাতা দেখে হেসেছো মা।
বোকা ছেলে! হাসবো কেন? তোর শব্দ ভূতদের দেখে মজা করেছি। আয়, তোকে একটা জিনিস দেখাই। বাংলা ব্যাকরণের একটা বই রীমার হাতে। বইটা খুলে সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের পাতা ওল্টায়। এখানে কিছু শব্দ দেখাবো। লেখাটা নিয়ে আয়।
না। ওটা আর দেখতে হবে না। অভির অভিমান আরো বাড়ে।
নিয়ে আয় না। ম্যাজিক দেখবি। রীমা তাড়া দেয় ছেলেকে।
অলস পায়ে হেঁটে অভি খাতাটা নিয়ে এসে মাকে দেয়।
বই আর খাতা পাশাপাশি রেখে রীমা এবার শব্দগুলো দেখায়।
এই দেখ্, ঝড় হলো তুফান। আর ঝর মানে ঝরা। পিট তো কোনো শব্দই নেই। যখন মারপিট হয় তখন বলা হয়। আর কেউ যখন কাউকে মারে তখন বলে পিটা দিয়েছে।
মার কথা শেষ হতে না হতে অভি হো হো করে হেসে ওঠে।
তারমানে আমি লিখেছি ঘরে ঘরে পিটা মানে মার তৈরি হয়!
সেটাই! রীমাও হাসে অভির সঙ্গে।
ওদের সঙ্গে হাসছে শীতের বিকেল। কমলা রঙের হাসি দেখতে দেখতে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। সুর্যটা আরো গোল হয়ে তাকিয়ে দেখছে ওদের।
মা, এরকম আরো অনেক শব্দ আছে। এগুলো নিয়ে মুশকিলে পড়ে যাই। একটা সহজ উপায় বলো।
সহজ উপায় হলো পড়া।
এই ব্যাকরণ বই আমাকে মুখস্ত করতে বলবে না তো! অভি ভয় পেয়ে বললো।
ব্যাকরণ বই মুখস্থ করতে হবে কেন? যে বানান নিয়ে কোনো সমস্যার পড়বি সেটা দেখে নিবি। সমস্যা শেষ!
উফ! বোরিং বাংলা! অভি বিরক্ত।
তাই? তাহলে বলতো ভাঙার ইংরেজি কী?
খুব সিম্পল! ব্রেক।
গুড। এবার বলতো, স্পিড কমানোর জন্য গাড়িতে যে যন্ত্র আছে তার নাম কী?
আরে! এতো মহাজ্বালা! এটাও তো ব্রেক!
এবার বুঝলে? সব ভাষাতেই এরকম শব্দ থাকে। তাই তোমার পড়া ছাড়া উপায় নেই বাবা।
মা, এই পড়া পড়া গেম অনেক বিরক্তিকর। চলো কোথাও ঘুরে আসি। এসে পড়বো।
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রীমা। মায়া লাগে। তাদের ব্যস্ততার জন্য অভির ছুটির দিনগুলোও একা একাই কাটে। রীমা ঠিক করলো আজ বের হবে।
হঠাৎ শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।
ধুত্তেরি! আজও বাসায় বসে কাটাতে হবে। বৃষ্টির ওপর প্রচণ্ড রাগ অভির।
একটু পরেই থেমে যাবে বাবা। এটা ছিঁচ কাঁদুনি বৃষ্টি। এখনই থেমে যাবে।
ছিঁচ কাঁদুনি! এটা আবার কী? শব্দটা অভি শোনেনি আগে।
এই যে, সকাল থেকে তুই কয়বার রাগ করলি? আর কয়বার হাসলি? বর্ষা শেষের বৃষ্টিটাও এরকম। মায়ের কথা শুনে অভি আবার হো হো করে হেসে উঠলো।
সিআরবির গাছগুলো ঝকঝকে সবুজ। বৃষ্টি থামার পর বিকেলটাও কেমন সবুজ হয়ে আছে। শিরিষতলায় কাদা মাখামাখি করে ফুটবল খেলছে ছেলেরা। অভি ওদিকে এগুতেই হঠাৎ পিছলে গেলো।
রীমা ধরে ফেললো পড়ার আগে। সাবধানে হাঁটো বাবা। এখন পড়ে গেলে কী হতো? একটু পরে গেলেও কিছু হবে না।
মা, শব্দগুলো একরকম না হলে কী হতো! ভূতের মতো বদলে যায়।
রীমা হাসতে হাসতে বললো, তুই ভূত দেখেছিস!
লেখাটি শেয়ার করুন